ঢাকা ১০:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নোটিশ ::
আমাদের নিউজপোর্টালে আপনাকে স্বাগতম...

ফিরে আসার আনন্দে মেতেছেন ফিলিস্তিনিরা

তাদের কাছে যা কিছু ছিল—পোশাক, খাদ্য কিংবা কম্বল—যতটুকু তারা বহন করতে পারেন, তা নিয়েই টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে হেঁটে এসেছেন। মুখে হাসি নিয়ে আলিঙ্গন করছেন প্রিয়জনদের, কত মাস পর তাদের দেখা!

গাজা উপত্যকার মূল উপকূলীয় সড়কে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। পনেরো মাসের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উত্তর গাজায় ফিরে এসেছেন তারা।

ফুরফুরে মেজাজ—যদিও তারা জানতেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলসহ গাজা শহরের বড় একটি অংশ মাটিতে মিশে গেছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় কথা হলো—তারা ফিরে এসেছেন, নিজ ভূখণ্ডে, আবাসভূমিতে।

আর কোনোদিন নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে পারবেন কিনা; সেই শঙ্কাও জেগেছিল অনেকের মনে। ধারণা করেছিলেন, দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিতারণ করা হয়েছে তাদের।

‘এই যে প্রত্যাবর্তন, এটিই আমাদের বিজয়। আমরা বিজয়ী,’ বলেন ফিলিস্তিনি তরুণী রানিয়া মাখদাদা। উপকূলীয় পথ ধরে পরিবারের সঙ্গে গাজা উপত্যকায় ফিরছিলেন তিনি।

স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে গাজায় নিজের বাড়িতে আসেন ইসমাইল আবু মাত্তার। ইসরাইলি বোমায় তার বাড়ির একটি অংশ ভেঙে পড়েছে। এখন ঠিক করেছেন, ঘরের পাশে একটি তাঁবু গেড়ে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে মনোযোগ দেবেন।

‘ওখানের চেয়ে এখানে তাঁবু হলে ভালো হয়,’ বললেন ইসমাইল। ‘ওখানে’ বলতে মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় গাজায় বিস্তীর্ণ অপরিচ্ছন্ন আশ্রয়শিবিরকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। গেল কয়েক মাস ধরে তিনিসহ গাজার জনসংখ্যার বড় একটি অংশই এই আশ্রয়শিবিরে ছিলেন।

তিনি বলেন, আমাদের শঙ্কা ছিল, আর কোনোদিন পূর্বপুরুষদের ভূমিতে ফিরতে পারবো না।

ইসমাইলের দাদাসহ লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বসতবাড়ি ছিল বর্তমান ইসরাইলে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলে এই উপত্যকায় এসে আশ্রয় নেন তারা।

পায়ে হেঁটে, গাড়িযোগে ফিরছেন তারা

ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন, সোমবার (২৮ জানুয়ারি) থেকে উত্তর গাজায় ফিরতে শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের হিসাবে, যুদ্ধ শেষে দুই লাখ লোক এ পর্যন্ত তাদের বাড়িতে ফিরেছেন। ইসরাইলি হামলা থেকে আত্মরক্ষায় ১০ লাখ মানুষ দক্ষিণের দিকে চলে গিয়েছিলেন।

যুদ্ধের সেই দুর্দশার সঙ্গে তুলনা করলে ফিরে আসা ফিলিস্তিনিদের আনন্দ ছিল দেখার মতো।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ছবি, ভিডিও ও ড্রোন ফুটেজ থেকে দেখা যায়, গাজার মূল উপকূলীয় সড়ক হয়ে বিপুল মানুষ পায়ে হেঁটে উত্তর গাজার দিকে যাচ্ছেন। তাদের একপাশে ভূমধ্যসাগর, অন্যপাশে বিধ্বস্ত ভবন ও ধ্বংসাবশেষ। ইসরাইলি বাহিনী বোমা হামলা চালিয়ে কিংবা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এসব ভবন।

জিনিসপত্রভর্তি ব্যাগ ও ভাঁজ করা কম্বল বহন করছিল পরিবারগুলো। পুরুষদের কাঁধে ছিল শিশুরা অথবা খাবারের ঝোলা ও রান্নার গ্যাসের ক্যানিস্টার। নারীদেরও এক হাতে ছিল নাবালক শিশু ও অন্যহাতে পানির পাত্র।

ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট বোনকে নিয়ে মায়ের পিছু পিছু যাচ্ছে টেডি-বিয়ারের পায়জামা পরা একটি মেয়ে। একটি পোষা বিড়ালকে সে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। সালাহউদ্দিন সড়ক ধরে গাড়ি ও ট্রাকযোগেও ফেরেন ফিলিস্তিনিরা।

মুখে তাদের বিজয়ের হাসি। বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে একটি শিশুকে। বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের সঙ্গে আলিঙ্গন করছিলেন কেউ কেউ। হুইল চেয়ারে বসা এক বৃদ্ধা গাইছিলেন ১৯৪৮ সালের আগের একটি ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি গান।

‘তোমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াও, হে ফিলিস্তিনের জনগণ, তোমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াও। ফিলিস্তিন চলে গেছে, কিন্তু এটিই শেষ বিদায় না,’ মুখে আলতো হাসি মেখে গাইছিলেন বৃদ্ধা।

শেষে খোদার কাছে শুকরিয়া করে বলেন, ‘অনেক ধ্বংস, ক্ষুধা ও রোগবালাইয়ের পর আমরা নিজেদের বসতবাড়িতে ফিরে এলাম।’

ইউএনবি

ট্যাগস :

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

জনপ্রিয় সংবাদ

সারাদেশে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

ফিরে আসার আনন্দে মেতেছেন ফিলিস্তিনিরা

আপডেট সময় : ০৪:০৯:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

তাদের কাছে যা কিছু ছিল—পোশাক, খাদ্য কিংবা কম্বল—যতটুকু তারা বহন করতে পারেন, তা নিয়েই টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে হেঁটে এসেছেন। মুখে হাসি নিয়ে আলিঙ্গন করছেন প্রিয়জনদের, কত মাস পর তাদের দেখা!

গাজা উপত্যকার মূল উপকূলীয় সড়কে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। পনেরো মাসের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উত্তর গাজায় ফিরে এসেছেন তারা।

ফুরফুরে মেজাজ—যদিও তারা জানতেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তরাঞ্চলসহ গাজা শহরের বড় একটি অংশ মাটিতে মিশে গেছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় কথা হলো—তারা ফিরে এসেছেন, নিজ ভূখণ্ডে, আবাসভূমিতে।

আর কোনোদিন নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে পারবেন কিনা; সেই শঙ্কাও জেগেছিল অনেকের মনে। ধারণা করেছিলেন, দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বিতারণ করা হয়েছে তাদের।

‘এই যে প্রত্যাবর্তন, এটিই আমাদের বিজয়। আমরা বিজয়ী,’ বলেন ফিলিস্তিনি তরুণী রানিয়া মাখদাদা। উপকূলীয় পথ ধরে পরিবারের সঙ্গে গাজা উপত্যকায় ফিরছিলেন তিনি।

স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে গাজায় নিজের বাড়িতে আসেন ইসমাইল আবু মাত্তার। ইসরাইলি বোমায় তার বাড়ির একটি অংশ ভেঙে পড়েছে। এখন ঠিক করেছেন, ঘরের পাশে একটি তাঁবু গেড়ে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে মনোযোগ দেবেন।

‘ওখানের চেয়ে এখানে তাঁবু হলে ভালো হয়,’ বললেন ইসমাইল। ‘ওখানে’ বলতে মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় গাজায় বিস্তীর্ণ অপরিচ্ছন্ন আশ্রয়শিবিরকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। গেল কয়েক মাস ধরে তিনিসহ গাজার জনসংখ্যার বড় একটি অংশই এই আশ্রয়শিবিরে ছিলেন।

তিনি বলেন, আমাদের শঙ্কা ছিল, আর কোনোদিন পূর্বপুরুষদের ভূমিতে ফিরতে পারবো না।

ইসমাইলের দাদাসহ লাখ লাখ ফিলিস্তিনির বসতবাড়ি ছিল বর্তমান ইসরাইলে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলে এই উপত্যকায় এসে আশ্রয় নেন তারা।

পায়ে হেঁটে, গাড়িযোগে ফিরছেন তারা

ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন, সোমবার (২৮ জানুয়ারি) থেকে উত্তর গাজায় ফিরতে শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের হিসাবে, যুদ্ধ শেষে দুই লাখ লোক এ পর্যন্ত তাদের বাড়িতে ফিরেছেন। ইসরাইলি হামলা থেকে আত্মরক্ষায় ১০ লাখ মানুষ দক্ষিণের দিকে চলে গিয়েছিলেন।

যুদ্ধের সেই দুর্দশার সঙ্গে তুলনা করলে ফিরে আসা ফিলিস্তিনিদের আনন্দ ছিল দেখার মতো।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ছবি, ভিডিও ও ড্রোন ফুটেজ থেকে দেখা যায়, গাজার মূল উপকূলীয় সড়ক হয়ে বিপুল মানুষ পায়ে হেঁটে উত্তর গাজার দিকে যাচ্ছেন। তাদের একপাশে ভূমধ্যসাগর, অন্যপাশে বিধ্বস্ত ভবন ও ধ্বংসাবশেষ। ইসরাইলি বাহিনী বোমা হামলা চালিয়ে কিংবা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এসব ভবন।

জিনিসপত্রভর্তি ব্যাগ ও ভাঁজ করা কম্বল বহন করছিল পরিবারগুলো। পুরুষদের কাঁধে ছিল শিশুরা অথবা খাবারের ঝোলা ও রান্নার গ্যাসের ক্যানিস্টার। নারীদেরও এক হাতে ছিল নাবালক শিশু ও অন্যহাতে পানির পাত্র।

ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট বোনকে নিয়ে মায়ের পিছু পিছু যাচ্ছে টেডি-বিয়ারের পায়জামা পরা একটি মেয়ে। একটি পোষা বিড়ালকে সে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। সালাহউদ্দিন সড়ক ধরে গাড়ি ও ট্রাকযোগেও ফেরেন ফিলিস্তিনিরা।

মুখে তাদের বিজয়ের হাসি। বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে একটি শিশুকে। বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের সঙ্গে আলিঙ্গন করছিলেন কেউ কেউ। হুইল চেয়ারে বসা এক বৃদ্ধা গাইছিলেন ১৯৪৮ সালের আগের একটি ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি গান।

‘তোমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াও, হে ফিলিস্তিনের জনগণ, তোমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াও। ফিলিস্তিন চলে গেছে, কিন্তু এটিই শেষ বিদায় না,’ মুখে আলতো হাসি মেখে গাইছিলেন বৃদ্ধা।

শেষে খোদার কাছে শুকরিয়া করে বলেন, ‘অনেক ধ্বংস, ক্ষুধা ও রোগবালাইয়ের পর আমরা নিজেদের বসতবাড়িতে ফিরে এলাম।’

ইউএনবি