রোকনুজ্জামান: গেল বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়েছিল গাজা উপত্যকায় জায়নবাদি ইসরায়েলের বর্বরোচিত গণহত্যা। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে পরিচালিত এই হত্যাযজ্ঞে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম নিধনে ইসরায়েলের পক্ষেই ছিল বরাবর। ইরান ছড়া বাকি আরবদেশগুলির সকলেই নীরব। জর্ডান নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে জায়নবাদিদের সহযোগিতাই করে যাচ্ছে প্রকৃত অর্থে।
এরই মধ্যে হারিয়েগেছে একটি সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সাজানো-গোছানো গাজা শহর। প্রায় ৫০ হাজার লাশের উপর দাঁড়িয়ে সেই সভ্যতা আজ শুধুই ইতিহাস। নিশ্চিহ্ন হয়েগেছে ৪০ হাজার স্থাপনা। বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ মানুষ। স্বজন-সম্বল হারিয়ে বেঁচে থাকা ফিলিস্তিনিদের সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষুধা আর মৃত্যুর ভয়। থেমে নেই দখলদার জায়নবাদিদের ধ্বংসযজ্ঞ। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। গোটা আরব অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্যকারী ইসরায়েলের রক্তপিপাসা থামছেইনা। তারা ফিলিস্তিনসহ পার্শ্ববর্তী লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়াতেও চালিয়ে যাচ্ছে এই মানবতাবিরোধী গণহত্যা মিশন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, স্মরনকালের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হামলার মুখোমুখি হয় ইসরায়েল। এতে প্রায় ১২০০ জায়নবাদির মৃত্যু হয়। পরে ইসরায়েল এর প্রতিশোধ নিতে বছরজুড়ে গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালায়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এতে প্রায় ৪২০০০ লোক নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আহত প্রায় ১ লাখ। তবে নিখোঁজ ১১ হাজারের বেশি। যাদের অধিকাংশেরই ইসরায়েলি গুপ্ত হামলায় মৃত্যু হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এদিকে চলমান অবরোধের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাটিতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ৬৩০০০ হাজারের বেশি ভবনের দুই তৃতীয়াংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ধূলায় মিশে গেছে। যার ধ্বংসাবশেষের ওজন হবে ৪২ মিলিয়ন টনেরও বেশি।
দেশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে আরো জাণাগেছে, ইসরায়েলি হামলায় ৬১১টি মসজিদ ও তিনটি গির্জা ধ্বংস হয়েছে এবং ২১৪টি মসজিদ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৩৬ টি স্টেডিয়াম এবং জিমের পাশাপাশি ২০৬ টি প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হয়েগেছে।
এদিকে জাতিসংঘ জানায়, ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র স্থাপিত সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যাবস্থাপনার ৬৭ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
গেল জুনে প্রকাশিত জাতিসংঘের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকস এন্ড প্যালেস্টাইন এনভায়রনমেন্ট কোয়ালিটি অথরিটি’র তথ্যানুযায়ী চলমান যুদ্ধে গাজার জনসংখ্যার জন্য চাহিদার বিপরীতে ৯৪ শতাংশ পানির সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ বাসিন্দারা জনপ্রতি পৌনে ৫ লিটারের কম পানি পাচ্ছে যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) কর্তৃক নির্ধারিত দৈনিক জনপ্রতি নুন্যতম পানির চাহিদা হচ্ছে ১৫ লিটার।
অক্সফাম বলছে যে গাজার ৮৮ শতাংশ পানির কূপ এবং শতভাগ ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট (পানির লবণাক্ততা দূরীকরণ প্রক্রিয়া) ক্ষতিগ্রস্থ বা ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ফলে পানির উৎপাদন ৮৪ শতাংশই কমে গেছে।
অক্সফামের মতে, ইসরায়েল গাজার ৭০ শতাংশ পয়ঃনিষ্কাশন পাম্পিং স্টেশন এবং শতভাগ বর্জ্য জল শোধনাগার এবং জলের গুণমান পরীক্ষাগার ধ্বংস করেছে। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
শীতকালে এই পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে পারে বলে জানিয়েছে অক্সফাম। এতে খারাপ আবহাওয়ায় বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার মধ্যে মহামারির মত ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাবের আশংকা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
ইসরায়েলি হামলা থেকে রেহাই পায়নি গাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। জরিপে দেখাগেছে, প্রায় ১২৫ টি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩৭টি।
এদিকে, নাগরিকসেবাকেন্দ্র ও হাসপাতালসহ ২০১ টি সরকারি স্থাপনা ধূলায় মিশে গেছে যা গাজার নগরিকসেবা ব্যাবস্থানাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৭ লক্ষ নাগরিক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত।
অক্সফামের মতে, গাজার প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন “তীব্র মাত্রার ক্ষুধার” সম্মুখীন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিও অনুমান করেছে যে অর্ধ মিলিয়ন গাজাবাসী চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে।
ইসরায়েলি আগ্রাসন গাজার অর্থনীতিকেও ধ্বংস করেছে। দেশটির সরকারি মিডিয়া অফিসের ভাষ্যমতে গত এক বছরে অঞ্চলটির অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ১১০ শতাংশ।
ইউএন কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD) রিপোর্ট করেছে যে গাজায় দারিদ্র্য শতভাগ বেড়েছে, যা গণহত্যার আগে ৫০ শতাংশ ছিল।
UNCTAD আরও রিপোর্ট করেছে, সেচ ব্যবস্থা, গবাদি পশুর খামার এবং বাগান সহ গাজার কৃষি সম্পদের ৮০-৯৬ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে।
ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে গাজার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মত গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। অঞ্চলটির ৮২ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ধ্বংসের মুখে।
উল্লেখ্য, মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ আরব দেশগুলোর নাকের ডগায় জায়নবাদিরা যে ভাবে মুসলিম নিধন করছে তা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে দেখছে গোটা বিশ্ব। একমাত্র ইরান ছাড়া আর কোনো দেশই গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবাদও জানাচ্ছে না এবিষয়ে। তবে ইরান-পুষ্ট হিজবল্লাহর মতো কিছু সংগঠন প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে সিরিয়ান ও ইরাকি মিলিশিয়ারাও।